রোমান হলিডে । বিজয় দে।

 

রোমান হলিডে 

বিজয় দে

 

১৯৫৩ সালে নির্মিত “রোমান হলিডে” নিয়ে কিছু বলার আগে একবার নিজের দেশের দিকে মুখ ফেরাই। দেশ মানে রাজ্য ,রাজ্য মানে বাংলা। যুগ পাল্টে গেছে অনেক দিন, তবুও মনে হয়, বাংলা চলচ্চিত্রে রোমান্টিকতা  বলতে অনেকে যা বোঝেন, আমিও তাই, সেই আদি  ও অকৃত্রিম যুগল সুচিত্রা-উত্তম বা উত্তম-সুচিত্রা। “ওগো তুমি যে আমার” থেকে “এই পথ যদি না শেষ হয়”। এই ঘটনা-নির্ভর, সঙ্গীত নির্ভর রোমান্সের অতি অভিঘাত থেকে আজও যেন আমাদের মুক্তি নেই।  বাংলার পাশাপাশি “দিলীপকুমার-মধুবালা” জাতীয় হিন্দি মুভি নিয়েও কম-বেশি একই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা যায়, কিন্তু ,আপাতত আমরা এর থেকে দূরেই থাকছি। আমাদের  আজকের বিষয় শুধু ১১৮ মিনিটের সাদা-কালো ছবি “রোমান হলিডে”। ছবিটিকে যদি গল্প-অনুসারে ভাগ করা যায় তাহলে শিরোনাম-সহ এরকম দাঁড়াবে।

 

রাজকুমারীর মন ভালো নেই

ইওরোপের কোনও এক দেশের রাজকুমারী “প্রিন্সেস অ্যান” (ভূমিকায় অড্রে হেপবার্ন, যাকে সাহেবদের সুনীল-প্রণীত ‘নীরা’ বলতে ইচ্ছে করে) শুভেচ্ছা সফরে বেরিয়েছেন। লন্ডন, আমস্টারডাম, প্যারিস হয়ে এবার তিনি রোম মহানগরীতে। এরপর তিনি যাবেন গ্রীস বা এথেন্সে। যাই হোক রাজকীয় অনুশাসনে কঠিন শৃঙ্খলায় আবদ্ধ এই কবিতাপ্রেমী রাজকুমারীর জীবন।       প্রাণোচ্ছল রাজকুমারী চাইছেন মুক্ত বাতাস আর নিয়মের বেড়াজালের বাইরে এক স্বাধীন মানবিক জীবন। কিন্তু সেই চাওয়াটা যখন করায়ত্ত হয়না বা অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন তিতিবিরক্ত হয়ে ঘোষণা করেন, যা তার স্বভাবের বাইরে… 

“I hate this nightgown     

I hate all my nightgowns                                                              and I hate all my underwears too…   

why cant’ I sleep in pyjamas?”                                                                              

রোম শহরে দূতাবাসের থাকাকালীন তার প্রথম দিনের  কর্মসূচি ছিল এরকম

8-30  Breakfast with the Embassy staff                

9-00  Leaving for Polinari Automotive  Works         

10-35 Inspection of food and agricultural organization        10-55 Attend New founding home for orphans       

11-45 Back and rest.Then conference with the press  

1-00 Lunch with the Foreig n Ministry

3-05 Presentation of a plaque                               

4-10 Review of  special guard                                  

4-45 Back here to change….


রাতের বেলা ঘুমোনোর আগে রাজকুমারীকে যখন এই  কর্মসূচি শোনানো হোলো,তখন তিনি কার্যত বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন এবং মনে মনে দূতাবাসের রাজকীয় স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার  সিদ্ধান্ত নিলেন। ফলে ঘুমের ইঞ্জেক্সন প্রয়োগ করে শুইয়ে দেয়া হলেও তার  মন ছিল জাগ্রত। চুপিচুপি ,সবার অজান্তে, রাজপ্রাসাদ ছেড়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন পথে। যেন আমাদের পাঠ্য-পুস্তকের সেই কবিতার মতো “থাকবোনা কো বদ্ধ ঘরে দেখবো এবার জগৎটাকে”। এবং প্রাসাদ-বার্তায় ঘোষিত হোলো “প্রিন্সেস অ্যান অসুস্থ। আগামী কর্মসূচি  বাতিল”।


রাজকুমারীর রাত-সফর এবং “রাজকুমার”য়ের সাথে হঠাৎ দ্যাখা

এই তথাকথিত “রাজকুমার” আর কেউ নন। তিনি এই কাহিনীর রোমে কর্মরত “আমেরিকান নিউজ সার্ভিস”য়ের একজন সামান্য সাংবাদিক জো ব্র্যাডলী  (ভূমিকায় বিখ্যাত অভিনেতা গ্রেগরী পেক)। অনেক রাতে বাড়ি ফেরার পথে, তিনি যখন দেখলেন একটি সুবেশা মেয়ে ফুটপাতে চাতালে শুয়ে আছে এবং নেশাগ্রস্তের মতো আচরণ করছে, তখন তিনি স্বভাব-সুলভ সাহায্যের জন্য এগিয়ে গেলেন এবং এখানেই গল্পের পালাবদল ঘটে গেলো। পরিচয় জানেন না, তবু উপায়ন্তরহীন, তিনি বাধ্য হলেন মেয়েটিকে তার ফ্ল্যাটে নিয়ে আসতে।

তখনও কেউ কারোরই সঠিক পরিচয় জানাজানি হয়নি। কিন্তু দৃশ্য পাল্টাতে থাকলো দ্রূত। অনেক নাটকীয় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর’, সঠিক পরিচয় পাওয়ার পর’ রোমের রাস্তাঘাটে উথাল-পাথাল ঘোরাঘুরি করার পর’ একটি নিরুচ্চার প্রেমের জন্ম হলো।

 

রাজকুমারীর প্রত্যাবর্তন 

মাত্র দু’দিনের জন্য প্রাসাদের ঘেরাটোপের বাইরে এসে রাজকুমারী যেমন সাধারণ মানুষের জীবন-যাপনের সঙ্গে কিছুটা জড়িয়ে পড়লেন, এক অন্যরকম জীবন বা বন্ধুত্বের আস্বাদ পেলেন তেমনি তার ভবিষ্যৎ ইতিকর্তব্য সম্পর্কেও সজাগ হয়ে পড়লেন। তিনি তার প্রাসাদ-জীবনেই ফিরে যেতে চাইলেন। প্রেমের যেমন জন্ম হোলো তেমনি আবার বিচ্ছেদও ঘটলো দ্রূত। সবাই সবার পূর্ব-অবস্থানে ফিরে গেলেন। কিন্তু চলচ্চিত্রে এত মধুর, এত অশ্রু-সজল বিচ্ছেদ দ্যাখা খুবই কমই ঘটেছে আমাদের জীবনে। আশ্চর্য লাগে, এত মেশামিশি, তবুও I love you কথাটা একবারও গোটা ছবিতে উচ্চারণ করার প্রয়োজন হলো না!

কথা শেষ হলো না। যেটুকু তথ্য না জানালেই নয় --

১) রোমান হলিডে,প্রথম আমেরিকান ছবি যার গোটাটাই ইতালীতে নির্মিত হয়েছে

২) ছবিটি প্রস্তুতের সময় অড্রে হেপবার্নের বয়স ছিল মাত্র ২৪

৩) এই ছবি করেই অড্রে হেপবার্ন অস্কার পেয়েছিলেন

৪) এই ছবিতে ভেসপা স্কুটার ব্যবহৃত হবার পর ইতালীর বাইরেও এটি জনপ্রিয় হয় এবং কয়েক বছরের মধ্যে ৫ লক্ষ ভেস্পা বিক্রি হয়।

 

আরও একটি কথা 

১৯৯৩ সনে অভিনেত্রীর মৃত্যুর পর ,সমাধিক্ষেত্রে অড্রে হেপবার্নের প্রিয় কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রণীত ‘অমর প্রেম’ (মানসী) পাঠ করেছিলেন অভিনেতা ও বন্ধু গ্রেগরী পেক। কবিতাটির প্রথম  কয়েকটি লাইন যথাক্রমে বাংলা ও ইংরেজিতে।

তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি

শত রূপে শত বার

জনমে জনমে,

যুগে যুগে অনিবার।

 

I seem to have loved you in numberless forms,numberless times

in life after life, in age after age, forever...

                                                                 


হোমঠেক    সান্ধ্য জলপাইগুড়ি মূল পাতা

 


Comments

Popular posts from this blog

কল্যাণের সাথে কন্যামে । সত্যম ভট্টাচার্য

উপন্যাস পরিচয়। মুরাকামির উপন্যাস 'কাফকা অন দ্য শোর'। শুভ্র চট্টোপাধ্যায়

সাইকেলে নারীশক্তি আর টাউনের পুরোন যানবাহনঃ রণজিৎ কুমার মিত্র