সাইকেলে নারীশক্তি আর টাউনের পুরোন যানবাহনঃ রণজিৎ কুমার মিত্র
সাইকেলে নারীশক্তি আর টাউনের পুরোন যানবাহন
রণজিৎ কুমার মিত্র
জল’শহরের যানবাহনের কথা বললেই আমার প্রথমেই মনে পরে দ্বি-চক্রযান বা সাইকেলের কথা । ইংরেজি বাই-সাইকেলকে এখন বাংলায় শুধু সাইকেলই বলা হয়। ঊনিশ শতকের ইউরোপে এর উদ্ভব। দুই চাকা বিশিষ্ট এই যানবাহনটির কদর বিশ্বজুড়ে । ২০০৩ পর্যন্ত সারা বিশ্বে একশ কোটির বেশি নাকি সাইকেল তৈরি হয়েছে। সাইকেলের প্রথম আবিষ্কারের দাবী করেন অনেকেই । ১৮৪৭ সালে সাইকেল শব্দটি ফরাসীতে আত্মপ্রকাশ করে। জার্মানির কার্ল ভন ড্যারেন, ১৮১৭ সালে ম্যানহেইন শহরে তাঁর তৈরি সাইকেল পথে বের করে সবাইকে দেখান। ইদানিং জল’শহরে সাইকেলকে আমার নারী শক্তির শ্রেষ্ঠ প্রতীক বলে মনে হয়। শহরতলি থেকে বহু নারী সাইকেল চেপে শহরে আসেন, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তদের বাড়ির গৃহস্থালির কাজের সাহায্য করাকে তাঁরা জীবিকা করেছেন। সময় বাঁচানোর জন্য ঘর থেকে সাইকেল আরোহী হয়ে সাত বাড়ি–দশ বাড়ি ঘুরে তাঁরা কাজ করেন। জীবিকা সহায়ক এই সাইকেলটি তাঁকে কর্মশক্তি যোগাচ্ছে। সাইকেল আরোহী হয়েই স্বামী-পুত্র-পরিজনকে তাঁরা রক্ষা করছেন নিজস্ব উপার্জন দিয়ে। একদা জলপাইগুড়ির সভ্রান্ত বাড়ির মহিলাদের যাতায়াতের বাহন ছিল পালকি, পরিচারিকারা তাঁদের গৃহেই থাকতেন। সময়ের সাথে সাথে ওই শ্রমজীবী মহিলাদেরও নিজস্ব ঘরদোর যানবাহন হল। দেখতে ভাল লাগে সবুজ-সাথীর সাইকেল করে মেয়েরা স্কুল কলেজ করছেন, তবে শহরের ছবিটা একটু আলাদা, সাইকেলের বদলে মোপেড , স্কুটি-আরোহী মহিলারা বাড়ির পুরুষটিকে তোয়াক্কা না করে সন্তানকে টিউসন দিতে, স্কুলে পাঠাতে, বাজার করতে এমন কি দরকার হলে শ্বশুর-শাশুড়িকে পিছনের সীটে বসিয়ে ডাক্তারখানাতেও নিয়ে যাচ্ছেন। ধন্য ওম্যান এমপাওয়ারমেন্ট, ধন্য দিচক্রযান আরোহিণীরা ।
এবারে সান্যাল মহাশয়ের ঝোলা থেকে পুরনো জলপাইগুড়ি শহরের যানবাহনের গল্প বের করে আনিঃ “প্রায় অর্ধ শতাব্দী পূর্বে শহরে এল দুটো বাইসিকল। চললেই গোরুর দল তাড়া করত, ১৯১৪ সনে হিনডেল উড নামে একজন সাহেব ডাক্তার এক চাকার সাইকেল চরে বেড়াতেন। একটি বড় চাকা, তার মাঝখানে প্যাডেল, উপরে বসবার সীট, পেছনে বাঁকা রডের সাথে ছোট একটা চাকা লাগানো। সবসময়েই প্যাডেল করতে হত আর ছোট চাকাটি মায়ের পেছনে বাচ্চার মতো চলত । ১৮৬৬ সনে বিলেতে এইরকম সাইকেলের চলন ছিল, এর নাম ছিল ‘ভেলী পেড বা বোন সেকার’, চলিত কথায় বলা হত ‘পেনি-ফারদিং’ । এমন গাড়ি এখন দেখা যায়না, দু-চাকায় দেশ ছেয়ে গেছে
‘এল ঘোড়ার গাড়ি। রাজবাড়িতে একটি আর রহিম বক্স পেস্কার সাহেবের বাড়ির একটি ‘ল্যান্ডু ‘, এল দু চাকার ‘টমটম’। তারপর পালকি গাড়ি । ডাইক বা স্টুয়ার্টের রবার টায়ারের শব্দহীন গাড়ি, আর কাঠের চাকায় লোহার পাত চরানো গাড়ি। ক্যারিং কোম্পানি এইসব ঘোড়ার গাড়ি ভাড়ায় খাটাত ।
এল দুটো মোটর গাড়ি, রাজবাড়িতে ও পেস্কার সাহেবের বাড়িতে। প্রসন্ন দেব রায়কত, সাবালক হয়ে রাজা হয়েছেন। পেস্কার সাহেবের জামাই মুসারফ হোসেন উকিল হয়ে এসেছেন, মোটর তো চাইই। এই গাড়ি চলতে শুরু করলে গোরুর দল পেছনে তাড়া করত। ১৯২৪ সনে প্রথম এরপ্লেন নামলো রেসকোর্সে।
যানবাহন এর এই গল্প এখন ধূসর অতীত। সাইকেল, মোটর সাইকেল, মোটর গাড়িতে এখন শহরের পথ চলাই দায়। পদাতিকদের সবসময় প্রাণ হাতে করে চলতে হয়। শহরে শুধু রেসকোর্সেই নয়, ইংরেজ আমলের পরে, দেশ স্বাধীন হবার পর, পাঙ্গা ও আমবাড়িতেও এরোপ্লেন নামত। সেইসব পুরনো ঘি এর গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে শহরবাসী বর্তমানে আমোদ-আহ্লাদ করে, আর প্রতিটি নির্বাচনের আগে শহরবাসী শোনে বিমান বন্দর গড়ে তুলবার প্রস্তাব। জল’শহর থেকে প্রায় ষাট কিলোমিটার দূরের বাগডোগরা বিমানবন্দরে যেতে যেতে নেতাদের সেই সব প্রতিশ্রুতি কর্পূরের মতো উবে যায়।
তথ্যসূত্রঃ
'জলপাইগুড়ি সহরের একশো বছর ১৮৫৯ - ১৯৬৮' : চারুচন্দ্র সান্যাল। 'জলপাইগুড়ি জেলা শতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ , ১৯৭০'।
Comments
Post a Comment