খেলা, ফুটবল খেলা: সত্যম ভট্টাচার্য

 


খেলা, ফুটবল খেলা

সত্যম ভট্টাচার্য

 

আচ্ছা এই মুহূর্তে যদি প্রশ্ন করা হয় সাম্প্রতিক ভারত নিউজিল্যান্ডের মধ্যে চলা টি টোয়েন্টি সিরিজে ভারতীয় দলের সহ অধিনায়ক কে? খুব বড় ক্রীড়াপ্রেমী অথবা জুয়াড়ি ছাড়া এই প্রশ্নের  উত্তর পাওয়া যাবে না। অথবা রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের একদম লেটেস্ট আপডেট কি? বা কৃষ্ণ নামধারীদের রাজ্যের জেলে কি রকম তোষামোদ করা হচ্ছে? তাবড় কলহপ্রেমী লোকজন যারা সন্ধ্যাবেলায় ঘন্টাখানেকের অনুষ্ঠানটি দেখে  কলহবিদ্যা রপ্ত করার চেষ্টা করে থাকেন তারাও আজকাল এসবের খবর রাখছেন না। কারণ ফুটবল বিশ্বকাপ চলছে।

প্রশ্নটা হচ্ছে ঠিক কেন গোটা পৃথিবী তাদের বাকি সময়ের রোজনামচা ভুলে এক মাস এই মহোৎসবে ডুব দেন? মনে হয় এর কারণ খুব বড় ঘরকুনো লোকও মনের কোনো নিভৃত কোণে বাইরের পৃথিবীকে দেখার বা জানার একটা ইচ্ছে লালন করেন। আর এই ফুটবল মহোৎসব হচ্ছে তার একটি আদর্শ উপায়। কত কত দেশ গোটা পৃথিবী জুড়ে, তারা কে কোন মহাদেশে তা কি আমরা জানি? আচ্ছা ওয়েলস দেশটি কোন মহাদেশে অথবা কোস্টারিকা বা তিউনিশিয়া? সংবাদপত্র আগেও ছিল, এখনও আছে। বিশ্বকাপ চলাকালীন ক্রীড়া সাংবাদিকরা তাদের কলমের অনবদ্য মুন্সিয়ানায় খেলার খবর ছাড়াও এই সমস্ত দেশের সাথে আমাদের পরিচয় করান। আর এখন তো গুগলদা জিজ্ঞেস করলেই সে বিশ্বের যে কোন দেশের ঠিকুজি কুষ্ঠি সহ যাবতীয় আমাদের চোখের সামনে নিমেষে তুলে ধরবে। এছাড়াও একদম চোখের সামনে থাকলো সে দেশের পোশাক বা সংস্কৃতি নিয়ে উপস্থিত হওয়া গ্যালারীর লোকজন। কত রঙে মুড়ে তারা যে নিজেদের দলকে সমর্থন করতে আসেন তা যেন চোখে লেগে থাকে। মানুষের জীবন সবসময় এরকম রঙীন হয় না কেন?

এই প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে এলবছর আঠাশ আগের চুরানব্বই সালের বিশ্বকাপ। তখন আমাদের নবম শ্রেণী। না শাড়ি নয়, পাট করে আঁচড়ানো চুল। তবে ট্র্যাডিশন ভাঙছে। একশো বছরের পুরোনো স্কুলের জানালার পাশের বসার জায়গাগুলো ক্লাস শুরুর আগে দখলের জন্য যেন প্রতিযোগীতা। বেশী সাহসীরা নেমে পড়ছে পাশের রাস্তায়। কারণ পাশের স্কুলের মেয়েরা যে স্কুলে যাবে সে রাস্তাটি দিয়েই। তাদের চোখের একটি ঝলক বা মুখের একটু হাসি, আহা তা পেলেই তখন জীবন ধন্য হয়ে যায়। তখোনো আমরা দামোদর শেঠ হয়ে উঠিনি।

এত সবের পরেও প্রতিদিনের পড়া আমাদের স্যারদের দিতে হত। না হলে আমরা জানতাম যে সাংসারিক যাবতীয় ঝাল মেটানোর সফট টার্গেট হয়ে যাবো আমরা। আবার স্যারেদের মধ্যে এখনকার মতো পরের ছেলে পরমানন্দ ব্যাপারটাও আসেনি। তারা আমাদের সবভাবেই কেয়ার নিতেন। এমতাবস্থায় একটা সময় লক্ষ্য করা গেলো বেশ কিছুদিন অনেকেই আমরা পড়া দিতে পারছি না। অনেকেরই চোখ লাল, অনেকেই ক্লাসে ঢুলছে। কারণ তখন ওয়ার্ল্ডকাপ ফুটবল চলছে। একদিন এক স্যার রেগেমেগে বললেন- এইভাবে চললে তোরা প্রত্যেকে ফেল করবি মাধ্যামিকে। কোন ফিচেল যেন পেছন থেকে বলেছিল- মাধ্যমিক পরের বার দেওয়া যাবে কিন্তু বিশ্বকাপ তো আবার চার বছর পর। স্যার এতো রেগে গিয়েছিলেন যে লাল হয়ে গিয়ে মুখ দিয়ে আর কথা বের হচ্ছিল না উনার তখন।

কেন আমরা এই ওয়ার্ল্ডকাপ ফুটবল দেখি? ফুটবলে ফিফা র‍্যাঙ্কিয়ে ভারতের স্থান কোথায়? ভারতকে কি কোনোদিন বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলতে দেখা যাবে? সে আশা সুদূর পরাহত। তবু আমরা রাত জেগে খেলা দেখি। যিনি খুব বড় খেলাপ্রেমী নন তিনিও হয়তো চার বছরে এই সময়েই একটি বা দুটি রাত জাগেন। কেন জাগেন? আসলে পুরোটাই অনুভূতি বা ভালো লাগার বিষয়। এখন কার কোন জিনিস কখন ভালো লেগে যাবে সেটি তো বলা যায় না। আসলে সবাই চায় পৃথিবীর এই উৎসবে সামান্য সময়ের জন্য হলেও গা ভাসাতে।

তাই আমরা রাত জেগে খেলা দেখি। আগে যেমন আমাদের বাঁচা ছিল যৌথ বাঁচা, খেলা দেখাও তেমন ছিল যৌথ। সবাই মিলে কারুর না কারুর বাড়িতে আমরা হৈ হৈ করে খেলা দেখতাম। যারা ঘুমিয়ে পড়তো কানে সুড়সুড়ি দিয়ে তাদের জাগানো হত। তারপর মুড়ি চানাচুর চা হোতো হাফ টাইমে। সামনে লম্বা কারুর মাথা পড়ে গেলে সে গাট্টা খেতো। কে কোন দলের সাপোর্টার তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে লেগে যেতো গন্ডগোল। তবু খেলা শেষে একজন আরেকজনকে এগিয়ে দিয়ে গুটিগুটি সবাই বাড়ি যেত সবাইআবার পরের দিন দুপুরের ঠেক থেকে আলোচনা শুরু রাতের ম্যাচে কি হতে চলেছে তা নিয়ে।

মনে পড়ে খুব সম্ভবত নব্বই সালের বিশ্বকাপ। তখন ক্লাস ফাইভ বা সিক্স হবে হয়তো। পাড়ায় একজনের বাড়িতে বিশ্বকাপ দেখি আমরা কয়েকজন। আর সে বাড়ির সব লোক ঘুমায়। একদিন কি যেন হয়েছে,পড়া হয়নি বা এরকম একটা কিছু। পিতৃদেবের দাবড়ানিতে সে দিন আমার আর খেলা দেখতে যাওয়া হয়নি। খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ শুনি কে যেন ডাকছে আমার নাম ধরে। মফস্বলের নিশুতি রাত। যখন তখন দরজা খোলা যায় না চট করে। কয়েকবার ডাকার পর বোঝা গেল যে বাড়িতে খেলা দেখতে যাই সে বাড়ির কাকু চলে এসেছে ডাকতে। পিতৃদেব কি আর তখন আটকাতে পারেন? তার নাকের সামনে দিয়েই ড্যাং ড্যাং করে চলে গেলাম খেলা দেখতে।

আরেকবার কে যেন হাফটাইমে বলেছে চল তো একটু বাড়ি থেকে আসি। একই পাড়ায় কয়েকটা বাড়ি পরই তাদের বাড়ি। আজ থেকে পনেরো কুড়ি বছর আগে মফস্বলগুলিতে রাস্তায় রাস্তায় এত আলো ছিল নাঘর থেকে বেরিয়ে দেখি আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না এবং বহুক্ষণ ধরে পাচ্ছি না। অন্ধকার যে ওত তীব্রভাবে মনকে ধাক্কা দিতে পারে সেদিন বুঝেছিলাম।

মোটামুটি আশির দশকের শুরু বা মাঝামাঝির সময় থেকে আমাদের মফস্বলে টিভি আসা শুরু হয়েছিল। ছোট ছিলাম বলে ছিয়াশির বিশ্বকাপ মনে নেই। কিন্তু যারা তখন বড় তখন তাদের কাছে টিভি এবং খেলার স্কিল মিলে সে বারের বিশ্বকাপ একটা যেন বিপ্লব। এত সুন্দর হতে পারে ফুটবল খেলা! এখোনো কথা বলতে গেলে বিস্ময়ে যেন চোখে ঘোর লেগে থাকে তাদের। জেগে থেকেও স্বপ্নের মতো লাগতে থাকে চারপাশ। 

যাই হোক, এতক্ষণ তো বললাম মাঠের বাইরের কথা। এবারে আসা যাক মাঠের ভেতরের কথায়। আর আমাদের এখানকার লোকজনের স্বচক্ষে টিভিতে দেখা বিশ্বকাপ হচ্ছে ছিয়াশির বিশ্বকাপআর ছিয়াশির বিশ্বকাপ মানেই মারাদোনার বিশ্বকাপ। একটা লোক যদি একই সাথে চূড়ান্ত প্রতিভা আর চূড়ান্ত নষ্টামির মিশেল হতে পারে তাহলে তা মারাদোনা। চাইলে সে যা খুশী করতে পারে।

নিজের চোখে দেখা প্রথম বিশ্বকাপ নব্বইয়ের বিশ্বকাপ। ফুটবল খেলা যে ওত সুন্দর হতে পারে সেই প্রথম আমরা দেখলাম। মাঠ জুড়ে চাইলে ফোটানো যেতে পারে অজস্র গোলাপ। নব্বইয়ে জার্মানী জিতলেও আমরা সকলে মারাদোনার ডাইহার্ড ফ্যান হয়ে গেলাম। চুরানব্বইয়ে আরেকটু বড়। কে যেন শিলিগুড়ি গিয়ে স্পোর্টসস্টার না কি ম্যাগাজিন নিয়ে আসলো। তাতে মারাদোনার ছবি। আর সে বছরই হল ইন্দ্রপতন। খুব সম্ভবত ফুটবলের ঈশ্বর গ্রীসের সাথে তার বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচটি খেলেছিলেন। আর তার পরদিনই পেপারের সেই হেডলাইন। মারাদোনা চলে গেলো কিন্তু আমাদের সামনে যেন এক নতুন দুনিয়া খুলে গেলো। জানলাম মাদক মানে নেশার জিনিস আর সেই জিনিস নিয়ে মাঠে ভালো খেলা যায়। ছেলেপুলে নেশা করে মাঠে নামা শুরু করলো। আমরা জেনেছিলাম বটে কিন্তু ভুল জেনেছিলাম। নেশার জিনিস দম বাড়ায়। স্কিল বাড়ানো তার কাজ নয়। মারাদোনা দম বাড়ানোর জন্য সেটা নিয়েছিলেন। স্কিল ছিল তার ভগবানপ্রদত্ত। এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ে সেই সময়ই ঘটে যাওয়া একটি অলিম্পিকের ১০০ মিটার ফাইনালে কার্ল লুইস আর বেন জনসনের কথা।

যেমন ছিয়াশির বিশ্বকাপ ছিল মারাদোনার বিশ্বকাপ, আটানব্বইয়ের বিশ্বকাপ তেমনিই রোনাল্ডোর বিশ্বকাপ। না সিআর সেভেন নয়। তিনি তখনো এই এম্ফিথিয়েটারে পা রাখেননি। ইনি ব্রাজিলের রোনাল্ডো। প্রচন্ড অলস একজন স্ট্রাইকার। সেন্টার লাইনের এপারে সারাক্ষণ ঘোরাঘুরি করে যাচ্ছেন, কোনোভাবে যদি একটা ক্রস আসে। আর তিনকাঠি চেনা যেটা স্ট্রাইকারের সবথেকে বড়গুণ সেটা তার মধ্যে ছিল পুরোদমে। মাঝেমাঝে ভাবি এবারের এই নতুন অফসাইডের কবলে পড়লে তিনি কি করতেন? কয়েক সেকেন্ড সময়ের ব্যবধানে পায়ে বল পড়লে তিনি যে স্পীড তুলতেন তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।



হোমঠেক                               

Comments

Popular posts from this blog

কল্যাণের সাথে কন্যামে । সত্যম ভট্টাচার্য

উপন্যাস পরিচয়। মুরাকামির উপন্যাস 'কাফকা অন দ্য শোর'। শুভ্র চট্টোপাধ্যায়

সাইকেলে নারীশক্তি আর টাউনের পুরোন যানবাহনঃ রণজিৎ কুমার মিত্র