নতুন পাড়া । রঙ্গন রায়
রঙ্গন রায়
আমাদের পাড়ার নাম নতুন পাড়া। বহু পুরোনো হলেও শুধুমাত্র নামের জোরেই এই পাড়া কোনওদিন পুরোনো হবে না। আমাদের বাড়ির সামনের বাড়িতে একটা দাদু থাকত, সে বলত, এটা নতুন পাড়া নয়, এটা নিউটন পাড়া, এখানেই নাকি 'নিউটন' গাছ থেকে আম পড়া দেখে মাধ্যাকর্ষণের সূত্র আবিষ্কার করেছিল। আমরা বলতাম, "কিন্তু বইয়ে যে লেখা আছে আপেল?" দাদু তখন হঠাৎই অন্যমনস্ক হয়ে উঠে চলে যেত। সেই দাদু আমাদের সকলের পড়শি।
শহর হলেও পাড়ায় বিভিন্ন গাছ গাছালির প্রাচুর্য ছিল। আর দাদুর বাড়িতেই ছিল আম-লিচু-আমলকি-কুল গাছের বাগান। সকাল-সন্ধ্যা ঢিল পড়ত দাদুর টিনের চালে। তিনি একাই থাকতেন। কাজেই অত্যাচার গুলো মোটামুটি সহ্য করতে হত। অবিশ্যি সহ্য না করেই বা যাবেন কোথায়!
একবার মনে আছে আমরা সবাই মিলে ঢিলের বৃষ্টি শুরু করেছি আম খাওয়ার জন্য, সেটা গরমের ছুটির দুপুর বেলা ছিল। এরকম হয় না যে ক্লাসে সবাই চিৎকার চেঁচামেচি করছিল, এমনি সময় টীচার এলেন; তখন দেখবেন সবাই চুপ করে গেলেও কেউ কেউ থেকে যায় যে শেষ চিৎকারটা করে আর টীচারের চোখে অপরাধী হয়ে যায়, এক্ষেত্রেও ঘটনা তাই ঘটল। সবাই ঢিল ছোড়া থামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর আমি হাতের টিপ পরখ করার জন্য ঢিলটা সবেমাত্র কুড়িয়ে ছুড়তে যাব, অমনি দাদু ঘর থেকে লাঠি নিয়ে বেরিয়ে এলেন। ব্যাস আর কি! চোখে পড়ে গেলাম। তারপর দৌড় দৌড়! কিন্তু দাদু ততক্ষণে আমাকে দেখে ফেলেছে। সন্ধ্যায় বাড়িতে কমপ্লেন এল। আর আমাকে দাদু বলে গেল, 'ঠিক দুক্কুর বেলা, ভূতে মারে ঢেলা, তুমি কি ভূত?'
এধরণের সাধারণ সাধারণ ঘটনা সবার পাড়াতেই ঘটে থাকে। এ অভিজ্ঞতা নতুন কিছু নয়। সব পাড়াতেই কিছু এমনতর পড়শি থাকেনই, না হলে পাড়ায় থাকাটাই বাচ্চাদের কাছে ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে যায়।
এছাড়া ছিল আমাদের ক্রিকেট খেলার ধূম। এখন আমার বন্ধুরা, আমি ক্রিকেট খেলতাম শুনলেই চোখ কপালে তোলে। বিশ্বাস করে না। এরকমও হয়েছে পাশের বস্তি থেকে কয়েকজন ছেলে মিলে সকাল দশটা থেকে খেলা শুরু করে বিকেল তিনটে পার করে দিয়েছি। নাওয়া খাওয়া নেই। ছোটবেলার জোশই আলাদা। কিন্তু মাঠে ক্রিকেট খেলা আর শহুরে ছোট উঠোনে ক্রিকেট খেলার যে বিস্তর পার্থক্য তা সবাই জানে। বলে বলে আমরা ছক্কা হাকাতাম আর বল চলে যেত বিমল জেঠুর বাড়িতে। প্লাস্টিকের ৫০নম্বরের বল গুলো সাদা সাদা, সেগুলো আশেপাশের বাড়ির ঝোপে পড়তই আর সেখানেই সমস্যা। কতবার পড়শীরা আমাদের জন্য দরজা খুলবে আর বল দেবে! অতিষ্ট হয়ে একদিন জেঠু দরজা খোলে না আর, ভেতর থেকে জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, কাল পাবি, এখানে এত বল আসে কেন, হ্যাঁ?
আমরা মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে, সদ্য তখন প্রথম টীমের দুই ওভার হয়েছে, তাহলে আমরা ব্যাট করতে পারব না আজকে? বিমল জেঠুর উপর রেগে গিয়ে আমরা সবাই ঠিক করলাম, এর প্রতিশোধ নিতেই হবে। অর্জুন নামে বস্তির একটা ছেলে বকুল গাছ দিয়ে বেয়ে বেয়ে বাড়ির পিছনের জমিতে নেমে পড়ল। দারুণ জঙ্গল সেখানে। এদিকে আমরা এপারে আছি কখন বল আসে এই অপেক্ষায়, হঠাৎ পাচিলের ওপাশ থেকে উড়ে আসতে লাগল কদবেল। বল মনে করে ক্যাচ ধরতে দেখি সুস্বাদু ফল। ঘনঘন একটা করে বল আসতে শুরু করল এরপর ওপাশ থেকে। আমরা অর্জুনকে প্রায় ভগবান তুল্য পর্যায়ে ফেলতে যাব এমন সময় একটা হুরুমদাড়ুম শব্দ। অর্জুন বকুল গাছ ধরে পাচিলে উঠে লাফ দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ফেরার কোনও রাস্তা নেই। পাচিল অনেক উচু না হলেও তখন আমরা ক্লাস ফোরে পড়ি। একদম বাচ্চা বাচ্চা। কাজেই নাগাল পাচ্ছে না ও।
বিমল জেঠুর বাজ পড়ার মতো গলা শুনতে পেয়েই আমরা ওই পাচিলের পাশ থেকে দৌড়। অবশ্য কদবেল গুলো নিয়েই। কিন্তু অর্জুন বেচারা আটকে গেছে। শেষটায় প্রায় এক ঘন্টা ওকে আটকে রেখে যখন ছাড়ল, তখন আমরা ভয়ে কাটা হয়ে আছি। ও ফিরল খালি হাতেই, বলটা দেয়নি জেঠু। কিন্তু অর্জুনকে আটকে রাখল কেন?
অর্জুন ওর গায়ে কাটা দেওয়া শাস্তির যা বর্ণনা দিল, তা মনে করলে আজও গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায়। ১৭-র ঘরের নামতা ধরেছিল জেঠু। ও না পারায়, ওকে দিয়ে মুখস্ত করিয়ে তারপর ছেড়েছে।
এরকম অজস্র ঘটনা মনে পড়ে ইদানিং। একটা স্নিগ্ধ হাসি ফুটে ওঠে মনের স্মৃতি পুকুরে। ওই যে গান আছে না, "আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম", সেটাই মনে হয় এখন। সেই বলটা আমরা পাইনি কোনওদিন। পাড়ার সেই পড়শির কাছেই থেকে গেছে আজীবন। আজ সেই নিউটন দাদু নেই, বিমল জেঠুও নেই। পাড়া কত বদলে যাচ্ছে রোজ। বড় বড় ফ্ল্যাট আমাদের ছোট ছোট খেলার উঠোন কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু স্মৃতির পাড়া আর স্মৃতির পড়শি বরাবর থেকে যাবে নতুন হয়ে।
হোমঠেক সান্ধ্য জলপাইগুড়ি মূল পাতা
Comments
Post a Comment